সুরকার নয়, বাবা ছিলেন সাধক: সুপর্ণকান্তি ঘোষ
প্রকাশিত : ১৫:৩৩, ১০ জানুয়ারি ২০২৩
‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’, ‘সে আমার ছোট বোন’- গান দু’টি শুনলেই স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে মনে আসবে উপমহাদেশের কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী মান্না দে’র নামটি। তবে যার সৃষ্ট এমন কালজয়ী সুর কণ্ঠে তুলেছিলেন মান্না দে, তার পরিচয় অনেকের কাছেই হয়ত অজানা।
তিনি সুপর্ণকান্তি ঘোষ। তার আরেকটি পরিচয়, প্রখ্যাত সুরকার নচিকেতা ঘোষের ছেলে তিনি। ফলে সুর তার জন্মসূত্রেই পাওয়া।
বেশকিছুদিন আগেই বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন সুপর্ণকান্তি ঘোষ। সে সময় একুশে টেলিভিশনের ‘কথোপকথন’ অনুষ্ঠানে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে আসে গানের জগতে তার পদচারনা থেকে শুরু নানা স্মৃতিময় ঘটনা। বলেন বাবা নচিকেতা ঘোষের কথা, মান্না দে’র সাথে তার পরিবারের সম্পর্কের গল্প।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থাপনায় সোমবার (৯ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় একুশে টেলিভিশনে প্রচারিত অনুষ্ঠানে সুপর্ণকান্তি ঘোষ বলেন, শুধু মান্না দে’ই নন, অন্যান্য জনপ্রিয় শিল্পীদের সঙ্গেও তার স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
প্রথমবার বাংলাদেশে আসার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেক আগের। একাত্তর সালে যখন মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবার সঙ্গে বসে রেডিওতে যুদ্ধের খবর শুনতেন।
বাবা নচিকেতা সম্পর্কে তিনি বলেন, “তার মতো সুরকার আমরা কেউ নই। উনি একজন সাধক ছিলেন, সুরকার বললে কম বলা হয়। পশ্চিমবঙ্গে কোনো শিল্পী নেই যে তার সুরে গান করেননি।”
১৯৫৮ সালে জন্ম নেওয়া সুপর্ণকান্তি জানালেন গানের জগতে তার শুরু কিভাবে।
“আটান্নর এপাশে-ওপাশে একটা ফর্মুলা ছিল- উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন বা সাবিত্রী চ্যাটার্জি, হেমান্ত মুখপাধ্যায়ের কণ্ঠ, নেচিকেতা ঘোষের সুর, গৌরি মজুমদারের লেখা হলেই সুপারহিট। এমন কোনো গান নেই যা হিট নয়।
“আমার প্রথম গান পুলক বাবুর লেখা। প্রথমদিকে পুলক কাকা বাধাও দিয়েছিলেন। মান্না দে’কে বলেছিলেন, একি পোলাপানের কাজ, কুড়ি বছর বয়স হয়নি, গোফের রেখা ওঠেনি, ওকে দিয়ে পূজোর গান করাচ্ছেন। মান্না দে তো ‘সে আমার ছোট বোন’ শুনে কেঁদে ফেলেছিলেন, বলেছিলেন- আমি গাইবই। বিমান ঘোষও বাধা দিয়েছিলেন, কিন্তু মান্না দে জেদ করে অনেককে সুর করতে দিয়েছিলেন এই গানটি। তিনি নিজেও করেছিলেন। পরবর্তীতে সেই গানই ইন্টারন্যাশনালই হিট।যেকোনো বাঙালি ‘সে আমার ছোটবোন’ জানে।”
‘সে আমার ছোটবোন’ জনপ্রিয় গানটির সুর ১৭-১৮ বছর বয়সে করেন বলে জানান সুপর্ণকান্তি ঘোষ।
গানের সুর নিয়ে নিজের অপছন্দের কথাও জানান অকপটে।
তিনি বলেন, “মান্না দে বেঁচে থাকতেই তার ওপর একটা দামি বই বেরিয়েছিল। তাতে ভারতবর্ষের লতা মুঙ্গেশকার থেকে শুরু করে ক্লাসিক্যাল সিঙ্গাররা লিখেছেন। সেখানে আমাকেও একটা লেখা লিখতে বলেছিলেন। লিখেছিলাম এবং সেখানে দুটি গানের সুরকে অপছন্দের কথা বলেছিলাম। তার একটি ‘চাঁদ দেখতে গিয়ে তোমায় দেখে ফেলেছি’ ছিল বাবার সুরের। আর মান্না দে’র সুর করা ‘ললিতাকে আজ চলে যেতে বল না’। যদি সেই গান ছিল সুপারহিট।”
‘সে আমার ছোট বোন’ গানটির প্রসঙ্গে ফিরে তিনি স্বর্ণযুগের একটি মজার ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, “দ্বীজেন কাকা পুলক কাকাকে বলেছিলেন যে, এই গানটা নচিই বুঝি সুর করে রেখে গিয়েছিল। এটা শুনে আমি বলেছিলাম, এত্থেকে বড় পুরস্কার আর কিছুই হয় না। আমার জীবনের প্রথম সুর করা গান, সেটা তুলনা করা হচ্ছে একটা হিমালয়ের সঙ্গে। এ ধরনের অনেক কমেন্টস এসেছিল।”
সুপর্ণকান্তি জানান, গানের প্রথম দুই লাইনের সুর আড়াই তলা বাসে বসে করেন তিনি। বাড়ি ফিরে দুই-তিন দিনের মধ্যে পুরো গানের সুর শেষ করেন।
“মান্না দে বোম্বে থেকে ফিরে খবর দিলেন। সুর শুনে উনি স্তম্ভিত হয়ে যান। বললেন, অনেক দূর যাবে কিন্তু মাথাটা ঠাণ্ডা রেখ। তোমার মাথা তো তোমার বাবার চেয়েও গরম।”
বাবা নচিকেতা ঘোষ সম্পর্কে বলেন, “বেশির ভাগ গানের মুখরা বাবার লেখা। যেমন- মুকুটটা তো পড়ে আছে, রাজাই শুধু নেই; কাগজে লেখ নাম কাগজ ছিড়ে যাবে, পাথরে লেখ নাম পাথর ক্ষয়ে যাবে, হৃদয়ে লেখ নাম সে নাম রয়ে যাবে- এইটুকু বাবার লেখা। এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না যাতে মুক্তো আছে- এটা বাবার লেখা।
“এইটুকু লিখে ডিস্ট্রিবিউট করে দিতেন। পুলক লেখ, পুলক কাকাকে দিল। শ্যামল লেখ, শ্যামল কাকুকে দিল, গৌরি দেখতো পারিস কিনা- দিয়ে দিল। তিনজনকে লড়িয়ে দিল।”
তিনি আক্ষেপ নিয়ে বলেন, “বাঙলা গানের যে কদর বাংলাদেশে দেখেছি, সেই কদর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা বাংলা গানকে নিয়ে করে না। যে কদর বাংলাদেশিরা বাঙলা গান নিয়ে করে। আমি তো লেখা জিনিস বলিনা, আমার চোখে দেখাটাই বলছি।”
এএইচ